আজকের বাংলাদেশঃ মাদরাসা শিক্ষার অবদান
অধ্যক্ষ মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির হেদায়েত তথা সঠিক পথ প্রদর্শনের লক্ষ্যে যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। পথ হারা জনগোষ্টির নিকট আল্লাহর বানী সম্বলিত দাওয়াত পৌছাতে গিয়ে বহুকষ্ট, যন্ত্রনা ও লাঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে সে সব নবী ও রাসূল গণকে। তথাপি তারা সকল বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সত্যকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব তারা পূর্ণরূপে পালন করার সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। যার বদৌলতে আজ পর্যন্ত অসংখ্য লোক মহান রবের দাসত্ব করছে এবং এ পৃথিবীতে ইসলামী তাহযিব-তামাদ্দুন বা কৃষ্টি-কালচার অবশিষ্ট আছে। যুগের আবর্তন ও সময়ের ব্যবধানে, সাইয়্যেদুল আম্বিয়া জনাবে মুহাম্মদুর রাসূল (সা)-এর পদচারনা ঘটে এ মর্ত্যে। জাতির কর্নধার হিসেবে তিনি এ ধরায় আগমন করেন। তার দাওয়াত সে যুগের মানুষেরা খুব সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। অমানুষক জুলুম ও নির্যাতনে ও যখন রাসূল (সা) তার দাওয়াতী কার্য্যক্রম বন্ধ করেননি তখন ঐ অসভ্য জাতি রাসূল (সা) কে হত্যার মত ষড়যন্ত্র করে। এরই ধারাবাহিকতায় রাসূল (সা) নিজমাতৃভূমী ত্যাগ সহ যুদ্ধের ময়দানে রক্ত ঝড়িয়ে ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা সফ এ-আল্লাহ ইসলামকে বিজয়ী করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন। هوالذى ارسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله ولوكره المشركين অর্থাৎ তিনি যে মহান সত্তা যিনি তার রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন নিয়ে প্রেরণ করেন। যাতে অন্য সকল দ্বীনের উপরে ইসলামকে বিজয়ী করতে পারে। যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে। মূলত এটাই ছিল সকল নবী ও রাসূল এর প্রধান দায়িত্ব। দ্বীনকে বিজয়ী করার মহান দায়িত্ব সকল যুগের নবী রাসূল পালন করেছেন। সর্বশেষ নবী হিসেবে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা)কে ঐ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত করে গাইডলাইন হিসেবে আল কুরআনুল কারিম নাযিল করেন। মুহাম্মদ (সা) শেষনবী হিসেবে তার পরে কিয়ামত অবধি অন্য কোন নবী নতুন কোন দাওয়াত নিয়ে আসবে না এটা স্পষ্ট ভাবে ঘোষনা হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন- اناخاتم النبين لانبى بعدى (আমি শেষ নবী আমার পর আর কোন নবী আসবেনা) তবে রাসূল (সা) এর মিশন রক্ষা করতে নবীর স্থানে কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে অসংখ্য সৈনিক ও ইসলামী ঝান্ডা বাহী কাফেলা। এ কারনেই অতীতে অসংখ্য বার ইসলামী দাওয়াত কে ম্লান করতে অনেক সংঘবদ্ধ চক্র প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সকল বাধা অতিক্রম করে ইসলামের ঝান্ডা আজও স্বঅবস্থানে দন্ডায়মান। ইসলাম মানব জীবনের কল্যাণ ও উন্নতি নিয়ে এসেছে। একারনেই হাজারো বাধা অতিক্রম করে আজ ও মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। حق العباد বা মানবাধিকার বলতে যা বুঝায় তার ১০০% ভাগ নিশ্চিত করেছে ইসলাম। অধুনা বিশ্বে মানবাধিকার সংস্থা আত্মপ্রকাশের বহুকাল পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা) এর মাধ্যমে মানবাধিকার বাস্তবায়ন করার নমূনা দেখিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে যতগুলো ধর্ম বিরাজমান সবগুলো কোন না কোন স্থানে ত্র“টি যুক্ত। তবে ইসলাম এমন একটি জীবন বিধান যেখানে সমান্যতম অসংগতী নেই। এ ধর্ম মানবজীবনের সকল স্তরে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। সমাজের সর্বস্তরের জনগনের পূর্ণ স্বাধিনতা ও অধিকার বাস্তবায়নে ইসলামের বিকল্প নেই। বর্তমান যুগ, পৃথিবীর সূচনা কাল হতে সার্বাধিক প্রযুক্তি ও উন্নততর যুগ। এ যুগেও কোন মহাজ্ঞানী ইসলাম ধর্মের কোন বিধানকে অসামঞ্জস্য বলে আক্ষায়িত করতে পারছেনা। ইলামের প্রধান দুটি ভিত্তি কুরআন ও হাদীস। এদুটির অনুকরনে একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ মুমিন হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। সমাজের নেতৃত্বসহ যাবতীয় কর্মপদ্ধতীর দিক নিদের্শনা রয়েছে সেখানে। ফলে যে ঐ বিষয় ছাড়া বিকল্প কিছু অনুকরণ অনুস্মরণ করবে সে হবে পথ ভ্রষ্ট। রাসূল (সা) পৃথিবীতে আগমন করে মানব জাতিকে কুরআনের বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার জন্য আহ্বান করেছেন। অসভ্য জাতি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট জাতিতে পরিনত হয়েছিল সে সময়ের কুরআনের অনুসারিগণ। রাসূল (সা) পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও রয়ে গেছে কুরআন ও তার পথ নিদর্শন। এ দু’টি বিষয় কে আকড়ে ধরার মাধ্যমে হাজার বছরের পূরতন ধর্ম আজও স্বঅবস্থানে মহিয়ান। রাসূর (সা) ঘোষনা করেছেন- تركت فيكم امرين لن تضلوا ماتمسكم بهما كتاب الله وسنة رسوله অর্থাৎ আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা সে দু’টি বস্তু আকড়িয়ে থাক তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তাহচ্ছে কুরআন ও রাসূলের আদর্শ। এ গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয়কে সংরক্ষণ করতে গড়ে ওঠে যে প্রতিষ্ঠান তার নামই মাদরাসা। ইসলামী এ প্রতিষ্ঠান যুগে যুগে ইলমে অহির আলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে অগনিত প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়েছে ঐ দুটি মৌলিক ও মহান বিষয়কে রক্ষার লক্ষ্যে। ইসলাম বিদ্বেষী চীর শত্র“ ইহুদী ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায় এ দু’টি বিষয়কে ধ্বংস করতে যুগের পর যুগ বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগ করে আসছে। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবু তারা থেমে থাকেনি অতীতে মূসার সাথে ফেরাউন, ইব্রাহিমের সাথে নমরুদ, মুহাম্মদ (সা) এর সাথে আবু জাহেলের মত শয়তানের দোসররা যুগে যুগে ইসলামকে ধ্বংস করতে অপকৌশল ও হিংস্র থাবা মেরেছিল। কিন্তু রাসূলের অনুস্মরনে দীপ্ত তৌহিদী ঝান্ডাবাহী সৈনিকগন সকল অপচেষ্টাকে রুখে দিয়েছে। বর্তমান মাদরাসা শিক্ষা রাসূল (সা) এর আদর্শে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা যার শুরু দারুল আরকাম থেকে। পার্থিব কোন স্বার্থ সেখানে নেই। এ শিক্ষা ব্যবস্থা কে রহিত করতে এবং ইসলামের উপর আঘাত হানতে ১৭ শতকের দিকে ইংরেজ বাহিনী ব্যবসার নামে এদেশে আসে এবং এক সময় ক্ষমতা দখল সহ ভারতীয় উপমহাদেশের শাসন ব্যবস্থা হাতে নেয়। মাদরাসার আলেম ওলামাদেরকে নির্বিচারে হত্যা সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসে তারা মেতে ওঠে। ফলে ইসলামী বলে বলিয়ান সে সময়ের আলেম সমাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে এবং ইংরেজদের নগ্ন থাবা হতে মাদরাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষা রক্ষা করে। সে সময়ের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ মাদরাসা ও আলিগর বিশ্ব বিদ্যালয় সহ আরো কিছু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইংরেজদেরকে ভারত উপমহাদেশ হতে বিতাড়নে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালায়। অবস্থা বেগতিক দেখে ইংরেজরা কুটবুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি তারা তাদের নিজস্ব আদলে ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বর্তমান মাদরাসা শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা সেখান থেকেই সুত্রপাত হয়। একসময় বিপ্লবী ইসলামী সৈনিকদের চাপে ইংরেজ বাহিনী ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও থেকে যায় তাদের আদর্শে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুর্ভাগ্যজনক হলে ও সত্য যে আমরা মুসলিম হয়েও আজও তাদের দেয়া সেই নীতি ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে কিছু লোক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ছিল একই ভূ-সীমার অন্তর্ভূক্ত। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে পাকিস্তান নামের নতুন একটি রাষ্ট্র আলাদা হয় এবং সেখান থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামের আলাদা দু’টি রাষ্ট্র গঠন হয়। ইতিহাসের পাতাগুলো স্বাক্ষ্য দেয় যে, ১২ শতকের দিকে ইসলামী কাফেলা এ ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। তাদের আচরনে মুগ্ধ হয়ে ইসলামে দিক্ষিত হওয়া শুরু করে সে সময়ের হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা। এ দাওয়াতী কার্যক্রম ও ইসলামের জ্যোতি নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম এ অঞ্চলে আসে । তাদের কার্যক্রম ছিল এতটা শক্তিশালী যে, স্বল্প দিনের ব্যবধানে গোটা ভারত উপমহাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের দাওয়াত। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এক সময় বাংলাদেশে ও ছোয়া লাগে ঐ অমীয় বানীর। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির মাধ্যমে অবসান ঘটে বাংলাদেশের হিন্দুবাদী শাসন ব্যবস্থার। শাহাজালাল, শাহপরান সহ অগনিত সূফী মাধকের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা এ দেশে ইসলামের গোড়া পত্তন হয়। অগনিত মসজিদ মাদরাসার ভিত্তি প্রস্তর হয়। ইসলামের দাওয়াত সর্বত্র পৌছাতে বিভিন্ন স্থানে খানকা তৈরী হয়। এ ভাবেই সমগ্র বাংলাদেশে ইসলামী দাওয়াত পৌছে যায়। এ কথা স্পষ্ট যে আমাদের পূর্বসূরীরা কয়েক শত বছর পূর্বে হয়তো অন্য ধর্মের অনুসারী ছিল। বর্তমানেও কিছু লোক সেই পূর্বসূরীদের ধর্মে ফিরে যেতে চায়। ধর্মীয় অনুসাশন ও শিক্ষা তাদের গাত্র দাহন করে। তারা সেই ইংরেজদের দোসর হয়ে পূর্বজীবনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে কাজ করছে। সর্বত্র বিধর্মীয় শিক্ষা ও কৃষ্টি কালচার প্রতিষ্ঠা করতে একাত্মতা ঘোষনা করেছে। সময় এসেছে মুসলিম জনতার সচেতন হওয়ার নইলে এদেশ আজ থেকে আড়াইশ বছরের পূর্বের ইংরেজ বাহিনীর মত অপর একটি দল এদেশের স্বাধীনতা খর্ব করে শাসন ভার গ্রহণ করবে এবং বহুকষ্টে অর্জিত এ ধর্ম ও স্বাধীনতা আমরা হারিয়ে ফেলবো। পৃথিবীর মানচিত্রে ভোগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। তাছাড়া বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্টির দিক দিয়ে দ্বিতীয়। এ দেশের মোট জনসংখ্যার ৮৭ ভাগ মুসলমান। এ দেশের মানুষ ইসলাম প্রিয় শান্তিকামী। দেশের জন্য একটি শিক্ষানীতি খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আজও তা হয়ে উঠে নাই। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর একটি কমিটি করে। কমিটি খুবই তড়িগড়ি করে একটি খসড়া শিক্ষানীতি জাতীর সামনে পেশ করে। সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের আকিদা বিশ্বাসের পরিপন্থী হওয়ায় ইতোমধ্যে জাতি এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফ্যাসিবাদী ও তৌহিদ বিরোধী কোন শিক্ষা যদি বাধ্যতা মূলক ভাবে জাতির উপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয় তবে কোন সচেতন নাগরিক এ চক্রান্ত সফল হতে দিবে না। বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার ভূমিকা ও অবদান অপরিসিম। নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে মাদরাসা শিক্ষার অবদান সংক্ষিপ্ত ভাবে উল্ল্যেখ করা হল।
মানুষের সামাজিক পরিচয় ও মাদরাসা শিক্ষাঃ
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এ ধরায় প্রেরণ করেছেন তার দাসত্ব করার লক্ষ্যে। আল-কুরআনে এ ব্যাপারে ঘোষণা- وما خلقت الجن والانس الاليعبدون (আমি মানব ও জ্বিন জাতিকে আমার ইবাদত করার লক্ষ্যেই সৃষ্টি করেছি) ইসলাম একটি পূণার্ঙ্গ জীবন বিধান। প্রতিটি কর্মে ইসলামী বিধানাবলীর অনুসরণ বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে কোন কর্ম হালাল কোনটি হারাম এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে সে মোতাবেক আমল করা সম্ভব নয়। তাই অহি প্রদত্ত ইলম অর্জন করা প্রতিটি মুমিনের জন্য ফরয। মাদরাসা শিক্ষা এ দায়িত্ব পালন করছে। এ কারণে মাদরাসা শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি।
মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাঃ
মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অহী ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা। যা মূলত পবিত্র আল-কুরআন ও বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূল (সা) এর হাদীস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ শিক্ষার সূচনা হয় ঐশী বাণীর সর্ব প্রথম গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দারুল আরকাম থেকে।’ রাসূল (সা)-কে ধরায় যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয় তাহাই আজ মাদরাসা শিক্ষা দ্বারা বাস্তবায়িত হচ্ছে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর ঘোষনা হচ্ছে।
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
“মহান সে সত্ত্বা যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পড়ে শুনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। অথচ ইতোপূর্বে তারা সুস্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।” (সূরা জুময়াহ, আয়াত-২)
এ আয়াত দ্বারা রাসূল (সাঃ) কে শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, রাসূল (সা) ছিলেন আদর্শ শিক্ষক ও সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। রাসূল (সা) নিজেই বলেছেন – بعثت معلما অর্থাৎ আমি শিক্ষক রুপে প্রেরিত হয়েছি। অন্য হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেন-بعثت لاتمم مكارم الاخلاق অথাৎ আমি প্রেরিত হয়েছি উত্তম স্বভাবের পূর্ণতা স্বরুপ। রাসূল (সা) ছিলেন আদর্শ শিক্ষক এবং উত্তম আদর্শের অধিকারী। আল্লাহ তার চরিত্র সম্মন্ধে বলেছেন- انك لعلى خلق عظيم অথাৎ আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী। অন্যত্র ঘোষণা করেছেন- لقد كان لكم فى رسول الله اسوة حسنة “(হে মানব সকল) আল্লাহর রাসূলের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।”
রাসূল (সা) এর আদর্শে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান মাদরাসা শিক্ষা, কুরআন-হাদীসসহ পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে দিক নিদের্শনা দিয়ে থাকে। যদি ও আমাদের দেশে প্রচলিত দু-ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। তবে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা রাসূল (সা) এর আদর্শ, কুরআনের বিধানাবলীর বাস্তব গ্রয়োগ সম্ভব হচ্ছেনা। পক্ষান্তরে ইসলামী শিক্ষা আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি রাসূল (সা) এর আদর্শ ও আল কুরআনের পূর্ন বাস্তবয়ান করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ইহকালিন শিক্ষা নয় বরং বৈধ-অবৈধ এর স্পষ্ট ধারণা, হালাল হারামের পার্থক্য, ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক নিদের্শনা দেয়া হয়। মোট কথা মাদরাসা শিক্ষা একজন মানুষকে ইহ জগতের সফলতা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে সজাগ করে তোলে।
সামাজিক জীবনে মাদরাসা শিক্ষাঃ
মাদরাসা শিক্ষা শুধু ধর্মীয় শিক্ষা দ্বারাই সীমাবদ্ধ নয়। পার্থিব অন্যান্য শিক্ষা সামাজিক জীবনে যতটা উন্নয়ন সাধন করতে না পারে মাদরাসা শিক্ষা তার চেয়ে অনেক বেশী অগ্রগামী। মাদরাসা শিক্ষা সামাজিক জীবনের যাবতীয় অবক্ষয় হতে রক্ষা করার প্রধান ভূমিকা রাখে এবং রেখে আসছে। নিম্নে তা হতে কতিপয় বিষয় উপস্থাপন করা হল-
দূর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠনঃ
দূনীতি সমাজ উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। জাতীয় স্বার্থের কোন বিবেচনা না করে আত্ম-তুষ্টির পাশবিক উল্লাস দেখা যায় শুধু দূর্নীতির সর্বব্যাপীতার কারণে। সেখানে মাদরাসা শিক্ষা মানুষকে দূর্নীতি থেকে বিরত রাখতে পারে। পার্থিব আইনের পাশাপশি পরকালের জবাবদিহিতা ও আল্লাভীতি দুর্নীতি থেকে বিরত রাখতে পুরোপুরি সক্ষম।
আমানতদারী সৃষ্টি করাঃ
যার মাঝে আমানত রক্ষার কোন প্রয়োজন উপলব্ধি হয়না এবং পরকালে এর পুংখানুরুপে হিসাবের কাঠ গড়ায় দাঁড়ানোর ভীতি যার মাঝে জাগ্রত হয় না শুধুমাত্র পার্থিব শাস্তির বিধান তাকে সে আমানতের প্রতি দায়িত্ববান হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম নয় এবং তাকে দুর্নীতি হতে ও বিরত রাখা অসম্ভব। তাই মাদরাসা শিক্ষার সিংহভাগ তৌহিদী শিক্ষা, যার কারনে সেখানে আমানতের পূর্ণ সংরক্ষনের উপর জোর দেয়া হয় এবং ইসলামের ঐশী বাণী আমানত রক্ষার ব্যাপারে যে কঠোরতা রয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেন। إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا ”নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে তোমরা যেন আমানত তার মালিকের কাছে প্রত্যাবর্তন কর।” (সূরা নিসা আয়াত- ৫৮) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ “হে মুমিনগণ তোমরা আল্লাহ, তার রাসূল ও তোমাদের উপর ন্যাস্ত আমানতের খেয়ানত করো না, অথচ তোমরা এর গুরুত্ব জান।” (সূরা আনফাল আয়াত- ২৭) রাসূল (সা) বলেছেন- لاايمان لمن لاامانةله “ঐ ব্যক্তির ঈমান নাই যার আমানত নাই।”
ঘুষের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করাঃ
ঘুষ হল দুর্নীতির মধ্যে অন্যতম, যে সমাজ বা রাষ্ট্রে ঘুষ আদান প্রদান করা হয় সে সমাজে কখনো শান্তি ফিরে আসে না। আল্লাহ তায়ালা এ ব্যপারে ঘোষণা দিয়েছেন- ولاتأكلو اموالكم بينكم بالباطل “তোমরা একে অন্যের সম্পদে অবৈধ পন্থায় ভোগ করো না (সূরা বাকারা আয়াত- ১৮৮)” রাসূল (সা) বলেছেন- لعنة الله على الراشى والمرتشى “ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ।” (বুখারী-মুসলিম)
দুর্বৃত্তায়ন রোধঃ
চুরি, ডাকাতি অন্যের সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও আত্মসাৎ করনের মত কাজ গুলো মানুষের দ্বারা তখনই হয় যখন তার মাঝে দ্বীনী জ্ঞান না থাকে। মাদরাসা শিক্ষা দ্বারা এ সকল অপরাধের পার্থিব ও পরকালিন যে ভয়াবহতা রয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় যেমন আল্লাহ বলেছেন- السارق والسارقة فاقطعوا ايديهما جزاء بما نكلا চোর এবং চোরনী তোমরা তাদের হস্ত কর্তন কর, এটা তাদের দুষ্কর্মের প্রতিদান। হাদীসে বর্ণিত আছে- রাসূল (সা) বলেছেন- وايم الله لوان فاطمة بنت محمد سرقت لقطع محمد يدها অর্থাৎ আল্লাহর শপথ যদি ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা) চুরি করতো তাহলে মুহাম্মদ (সা) তার হাত কেটে দিত। (বুখারী )
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাঃ
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা হলে সমাজে কোন অন্যায় কাজ সংঘঠিত হতে পারতো না। মাদরাসা শিক্ষা ন্যায় বিচার এর ক্ষেত্রে সূস্পষ্ট বিধান ও ধারনা দিয়ে থাকে যেমন দুর্নীতি প্রতিরোধে রাসূল (সা) দৃপ্ত কন্ঠে বলেছেন- من رأى منكم منكرا فليغير بيده فان لم يستطع فبلسانه فان لم يستطع فبقلبه وذالك اضعف الايمان অর্থাৎ তোমাদের কোন কেউ যদি অসৎ কাজ সংঘঠিত হতে দেখে সে যেন তা হাতের শক্তি প্রয়োগ করে, তা প্রতিহত করে যদি সে শক্তি না থাকে তাহলে যেন মুখের কথা দ্বারা প্রতিহত করে, যদি সে শক্তিও না থাকে তাহলে যেন অন্তর দ্বারা সেটাকে প্রতিহত করার ব্যাপারে গবেষনা করে- আর এটা হল ঈমানে নিম্ন স্তর। এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যদি দুর্নীতি দেখা সত্বে ও সেটা বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে ঈমানের কোন স্তর ঐ সকল লোকদের মধ্যে অবশিষ্ট থাকেনা।
নৈতিকতা বোধের সৃষ্টিঃ
সামাজিক জীবনে নৈতিক চরিত্রই প্রধান বিষয়, যা সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। যে সমাজের লোকজন নৈতিক চরিত্রহীন হয়ে যায় তারা পশু সমতুল্য। হক-হালাল, সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ, জায়েজ-নাজায়েজ ইত্যাদি ব্যাপার গুলো মেনে চলা এবং তার প্রতিফলন ঘটানো সমাজের প্রতিটি লোকের অপরিহার্য বিষয়। আর এ সকল বিষয়ে তখনি শ্রদ্ধাবোধ আসে যখন নৈতিক চরিত্র নীতি বোধ থাকে। আর নৈতিক চরিত্র সুন্দর করনে মাদরাসা শিক্ষার বিকল্প নেই। কারন এ শিক্ষা দ্বারা মানুষ কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান লাভ করে এবং এতে তার আত্মিক ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধি সাধন হয়। রাসূল (সা) এ প্রসঙ্গে বলেছেন- ان من خيار كم احسنكم خلقا অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সে যার চরিত্র তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।
পরকালিন জবাবদিহীতাঃ
পার্থিব জগতের অবৈধ উপার্জনের ব্যপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহীতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা থাকলে দুর্নীতি ও আত্মসাৎ করারমত জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস পেত না। আল্লাহ তায়ালার বাণী- وامامن خاف مقام ربه ونهى النفس عن الهوى فان الجنة هى المأوى যে তার প্রভূকে ভয় করে এবং নিজেকে আত্ম থেকে বিরত রাখে নিশ্চয় তার ঠিকানা হবে জান্নাত। রাসূল (সা) একদা সাহাবীদের জিজ্ঞেস করেছেন তোমরা কি জান সর্বাপেক্ষা হতভাগ্য কে? তারা বললো যার ধন-সম্পদ নেই সেই হতভাগ্য। রাসূল (সা) বললেন না, “হতভাগ্য ঐ ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন অঢেল নেকী নিয়ে উপস্থিত হবে কিন্তু এক এক করে বহু পাওনাদার তার তার কাছে দুনিয়ার যত সম্পদ ও অপরের হক নষ্ট করেছে তার জন্য আল্লাহর কাছে বিচার দাবী করবে। আল্লাহ তখন ঐ সকল লোকদের পাওনাকে নেকী দ্বারা আদায় করতে বলবে (যেহেতু পরকালে কোন সম্পদ থাকবে না) দেখা যাবে তার নেকী শেষ এখনো পাওনাদার বাকী, তখন আল্লাহ বলবেন তোমাদের গুনাহ তাকে দিয়ে তোমাদের নেকীর পাল্লা ভারী করো। এভাবে এক সময় ঔ ব্যক্তির গুনাহরাশি বিশাল পর্বতের মত হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” যার মাঝে এ ভীতি থাকবে সে কখানে দুর্নীতি করতে সক্ষম হবে না। এ শিক্ষা দ্বারা পারলৌকিক জীবনের জবাবদিহীতা সম্পর্কে মানুষ পূর্ণ ধারনা পেয়ে থাকে।
তাকওয়া অর্জনঃ
تقوى অর্জন মাদরাসা শিক্ষার অন্যতম একটি বিষয়। তাকওয়া অর্জিত জাতি কোন অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারেনা। আল্লাহ তায়ালা তাকওয়া অর্জনের জন্য কুরআনের অসংখ্য স্থানে ঘোষনা দিয়েছেন। তিনি বলেন- يايها الذين امنواتقوالله হে ঈমানদারেরা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। অন্যত্রবলা হয়েছে-ان الله مع الذين اتقوا والذين هم محسنون নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন যারা মুত্তাকী এবং যারা সৎকর্ম সম্পাদন করে। তেমনি আল্লাহর বাণীতে আরো বলা হয়েছে- واتقو الله لعلكم تفلحون তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার।
দুর্নীতির মূলে একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে তাকওয়া সম্পর্কে উদাসিন থাকা। ইহজীবন শেষে একটি অনন্তকালের জীবনে আমরা চলে যাব, যেখানে ইহ জগতের সকল কর্ম কান্ডের হিসাব হবে সে ভয়-ভীতি আমাদের মাঝে অনুপস্থিত। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- انا انذرناكم عذابا قريبا يوم ينظر المرء ماقدمت يداه ويقول الكافر ياليتنى كنت ترابا অর্থাৎ “আমি (আল্লাহ) তোমাদেরকে অত্যাসন্ন শাস্তির সতর্ক করছি যেদিন মানুষ তার দুহাত যা অর্জন করেছে তা দেখতে পাবে এবং কাফেরগণ বলবে হায়! যদি আমি মাটি হয়ে যেতে পারতাম।” তাই পরকালিন ভয়-ভীতির অভাবে মানুষ দুর্নীতির সুযোগ পায়। এ সকল অন্যায় ও পাপাচার থেকে মানুষ কখন রেহাই পাবে যখন তার মাঝে তাকওয়া বা খোদাভীতি থাকবে। মাদরাসা শিক্ষা দ্বারা তাকওয়ার অর্জন এবং তাকওয়ার গুনে গুনান্বিত মুত্তাকী হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অর্থ লিপ্সা ও উচ্চাভীলাষ বর্জনঃ
মাদরাসা শিক্ষা মানুষকে যে শিক্ষা প্রদান করে তাহতে একটি হল পরকালিন বিষয়ে উৎসাহ প্রদান এবং ইহকালিন সুখ সমৃদ্ধি ও ধন-দৌলতের প্রতি অঘাদ মোহকে হ্রাসকরা। এর বাস্তব কারন পার্থিব জগতের মোহ সকল মানুষের সত্বাগত ভাবেই জেগে ওঠে। তাই এ ব্যাপারে কোন উৎসাহ না দিয়ে পরকালিন বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যেমন রাসূল (সা) বলেছেন- كن فى الدنيا كانك غريب اوعابر سبيل অর্থাৎ পৃৃথিবীতে বসবাসের ক্ষেত্রে এমন হও যেন তুমি নিংস্ব অথবা পথের পথিক। তেমনি রাসূল (সা) এর অন্য একটি বাণী হচ্ছে- ان اكرمكم عندالله اتقاكم অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বোপেক্ষা সম্মানিত যে তোমাদের মাঝে বেশী আল্লাহ ভীরু। রাসুল (সা) এর এ সকল বাণী ছাড়াও বহু আয়াত ও হাদীস দ্বারা মানুষকে পরকালিন সম্মন্ধে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। পার্থিব চারিত্রিক উৎকর্ষতা সাধনের মাধ্যমে ইহকালিন ও পারলোকিক সফলতা অর্জনের প্রতি বিশেষ ভাবে গুরুত্বারোপসহ দুনয়ার মোহ থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কারো মাঝে রাসূল (সা) এর এ আদর্শ থাকলে সে কখনো দুর্নীতি, কালো বাজারী, অর্থ লিপ্সা ইত্যাদি অপকর্ম করতে পারে না।
স্বজন প্রীতি রোধঃ
স্বজন প্রীতি হল দুর্নীতির অন্যতম কারন। স্বজন প্রীতির কারনে নীতি-নৈতিকতা বোধ হারিয়ে যে কোন অন্যায় কাজ করতে উদ্যমী হয়। সমাজে অসৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। সমাজে চরম বিশৃংখলা, দুর্নীতি ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়। অপরের অধিকারকে অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ ও আত্মসাত করা হয়। রাসূল (সা) কঠোর ভাবে এ স্বজন প্রীতির বিরুদ্ধাচারন করে বলেছেন- الخلق عيال الله فاحب الخلق الى الله من احسن الى عياله অর্থাৎ সৃষ্টিজীব সব আল্লাহর পরিবারের সদস্য আর এদের মাঝে সর্বোত্তম সে যে তার পরিবারের সদস্যের সাথে সদাচারন করে। বিদায় হজ্বের ভাষনে রাসূল (সা) বলেছেন যে لافضل للابيض على الاسود ولافضل للعربى على العجم كلكم من ادم وادم من تراب “কৃঞ্চাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোন প্রধান্য নেই তেমনি অনারবের উপর আরবের কোন প্রধান্য নেই সব মানুষ আদম হতে আর আদম মাটি হতে।” অতএব স্বজন প্রীতি থাকলে সমাজে ন্যায় বিচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্বজন প্রীতি দ্বারা বহু অপকার্মের সৃষ্টি হয়। এ স্বজন প্রীতি থেকে মুক্ত হতে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন।
ইনসাফ প্রতিষ্ঠাঃ
যে কোন ব্যাপারে ইনসাফ না থাকলে সেখানে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোন রহমত ও বরকত থাকে না। সামাজিক ভারসাম্যতা বিঘিœত হয় বে-ইনসাফী করার কারনে। ইসলাম মানুষকে ইনসাফ কায়েম করার প্রতি জোর তাগিদ প্রদান করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনের ইরশাদ হচ্ছে- واعدلوا هو اقرب للتقوى অর্থাৎ তোমরা ন্যায় বিচার কর কেননা এটা তাকওয়ার ক্ষেত্রে অধিক নিকটবর্তি। অন্যত্র ঘোষণা হয়েছে- ان الله يأمر بالعدل والاحسان নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ ও মহানুভূতির নির্দেশ করেছেন।
ধোকা ও প্রতারনা রোধঃ
দুর্নীতির একটি শাখা হচ্ছে ধোকা দেয়া। ধোকা দিয়ে মানুষকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করা হয়, অথচ মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন- من غشنا فليس منا অর্থাৎ “সে আমার দলভূক্ত নয় যে ধোকা দেয়।” ধোকা মানুষের চরম অবনতির দিকে নিয়ে যায়, অনেক অসৎ কর্মের সৃষ্টি করে। একটি দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠনে ধোকা দেয়ার মত দুঃশ্চরিত্র থেকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে।
কালবাজারী ও মৌজুদারী প্রথার বিলোপ সাধনঃ
ইসলাম মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। যার বাস্তব একটি দৃষ্টান্ত হল খাদ্য দ্রব্য প্রয়োজনের অধিক পরিমাণে মজুদ রেখে অন্যকে কষ্টের মধ্যে নিপতিত করা বা মূল্য বৃদ্ধি করার মাধ্যমে জন দূর্ভোগ সৃষ্টি করাকে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে ইসলাম। এ সম্পর্কে রাসূল (সা) এর ঘোষণা হচ্ছে- من احتكر فليس منا অর্থাৎ ‘মুল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে খাদ্য-দ্রব্য মজুদ কারী আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’। তেমনি অপর একটি হাদীসে বর্ণিত আছে রাসূল (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্য-দ্রব্য মজুদ করে রাখে সে আল্লাহ থেকে সম্পর্কহীন হয়ে যায়, আল্লাহ তার সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না।
ওজন ও পরিমাপে সাবধানতাঃ
আল্লাহ ঘোষণা করেছেন-وزنوا بالقسطاس المستقيم অর্থাৎ তোমরা সঠিক ভাবে ওজন করে দাও। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন- وأقيمو الوزن بالقسط ولاتخسرو الميزان অর্থাৎ তোমরা দাড়ি-পাল্লায় বিশৃংখলা করো না, ইনসাফের সাথে সঠিক ভাবে ওজন কর এবং ওজনে কম দিও না। রাসূল (সা) সৎ ব্যবসায়ী ও যারা ওজনে ফাঁকী দিবে না তাদের ক্ষেত্রে বলেছেন- التاجر الصدوق الامين مع النبين والصدقين والشهداء অর্থাৎ সত্যবাদি ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, শহীদ ও সত্যবাদীদের সাথে হবে। আল্লাহ তায়ালা অন্য এক আয়াতে ঘোষণা করেছেন, ঐ সমস্ত ব্যবসায়ী ধ্বংস হোক, যারা জনসাধারনের কাছ থেকে যখন কোন জিনিস গ্রহণ করে তখন বেশি নেয়, আর যখন অন্যদের দেয় তখন কম দেয়।
চরিত্র সংশোধনঃ
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চরিত্র সংশোধন। মানুষের মধ্যে সৃষ্টিগতভাবে অর্থলিপ্সা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, পার্থিব মোহ ইত্যাদি দোষ বিদ্যমান যার প্রমাণ পরিত্র কুরআনে রয়েছে– زين للناس حب الشهوت من النساء والبنين والقنا طيرالمقنطرة من الذهب والفضة “মানুষের জন্য নারী, সন্তান, স্তুপকৃত সম্পদ, স্বর্ণ ও রৌপ্যের প্রতি মোহকে সু-শোভিথ করা হয়েছে।” তাই পার্থিব মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হলে প্রয়োজন চারিত্রিক উৎকর্ষতা যা মাদরাসা শিক্ষা ছাড়া আদৌ সম্ভবপর নয়। চারিত্রিক উন্নতি ছাড়া যেহেতু কোন জাতিই সফলতা লাভ করতে পারেনা বিধায় মাদরাসা শিক্ষা এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে।
দেশপ্রেম সৃষ্টিঃ
দেশ, জাতি কিংবা উন্নয়নের স্পৃহা মানুষের জাগৃতি ঘটে মূলতঃ দেশপ্রেম থেকে। মাদরাসা শিক্ষা তরুণ প্রজন্মকে সেই মহান দেশপ্রেমের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে বহুকাল থেকে। কুরআন ও হাদীসের দেশপ্রেমের আলোকিত দীক্ষা পেয়ে ছাত্র সমাজ আগামীর পৃথিবীতে নিজেকে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত হয়। কারণ, তারা শিখে حب الوطن من الايمان অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।
পরিশিষ্টঃ
উপরোল্লেখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলতে পারি যে, মানুষের নীতি-নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিনির্মান, সর্বোপরি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নেই। কারণ, শাশ্বত ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা ও কারিগরী শিক্ষার স্বর্ণালী স্পর্শে আগামী প্রজন্মকে সমাজ উন্নয়নে ব্রত হতে শেখায় মাদরাসা শিক্ষা। রুগ্ন সভ্যতাকে পরিশুদ্ধ করতে পরিশুদ্ধ মানুষের একান্ত প্রয়োজন। সেই পরিশুদ্ধ মানুষের উপর নির্ভর করে একটি সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন। মাদরাসা শিক্ষা সমাজ উন্নয়নের সেই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিশুদ্ধ প্রজন্ম বিনির্মাণের এক সফল দৃষ্টান্ত।